তেল ফসলের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে বিনা উদ্ভাবিত
তিলের জাতসমূহের সম্ভাবনা
ড. মো. আব্দুল মালেক১ মো. সৈকত হোসেন ভূইয়া২
যদিও জনবহুল এই দেশের মানুষ খাবার বলতে শুধু ভাতকেই বুঝে থাকে। কিন্তু শরীরে প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহের জন্য তেলফসল গুরুত্ব অপরিসিম। তেলফসল চাষাবাদ বাংলাদেশের কৃষিতে নতুন কিছু নয়। মানবদেহের জন্য অতি প্রয়োজনী সমস্ত উপাদান এতে বিদ্যমান রয়েছে। তেল ফসল হচ্ছে শর্করা, আমিষ, চর্বি, লৌহ, জিংক ও বিভিন্ন ভিটামিন যথা ভিটামিন এ, ভিটামিন ই, থায়ামিন ও রাইবোফ্লোভিনের গুরুত্বপূর্ণ উৎস। তেল ফসলে সিদ্ধ চালের (ভাত) তুলনায় প্রায় দ্বিগুণের বেশি আমিষ, অর্ধেক শর্করা, চার গুণের বেশি লৌহ ও জিংক থাকে। এছাড়া তেল ফসল চর্বির অন্যতম উৎস। দেশের ক্রমবর্ধান জনসংখ্যার জন্য নিরাপদ তথা পুষ্টি সমৃধ্য খাদ্য নিশ্চিত করা বর্তমান সময়ের কৃষি গবেষণায় নিয়োজিত কৃষি বিজ্ঞানীদের মূল লক্ষ্য। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) কর্তৃক উদ্ভাবিত তেলফসলের জাতের সংখ্যা ৩২টি। এদের মধ্যে সরিষার ১১টি, চিনাবাদামের ১০টি, সয়াবিনের ৭টি ও তিলের ৪টি জাত রয়েছে।
দেশের মানুষ গড়ে প্রতিদিন ২০ থেকে ২২ গ্রাম করে তেল গ্রহণ করে থাকে। চাহিদার এক তৃতীয়াংশের মতো পূরণ হয় দেশে উৎপাদিত তেল থেকে এবং বাকিটা আমদানি করে মেটানো হয়। দেশে তেলের ঘাটতি রয়েছে ৬৫ থেকে ৭০ ভাগ। এই বাস্তবতা বিবেচানা করে আমাদের এখনি সময় তেল ফসল চাষাবাদে গুরুত্ব দেয়া। দেশে প্রচলিত তেল ফসলের মধ্যে সরিষা, চীনাবাদাম, তিল, তিসি, সয়াবিন ও সূর্যমুখী চাষ হয়ে থাকে। এদের মধ্যে সরিষা, তিল এবং সয়াবিন থেকেই সাধারণত তেল বানোনো হয়। আমাদের দেশে প্রচলিত জাতের তেল ফসলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি তেল পাওয়া যায় তিল হতে। তিলে প্রায় ৪৩ ভাগ, সরিষায় ৪০ ভাগ, এবং সয়াবিনে ১৮ ভাগ তেল থাকে। তেল ফসলের মধ্যে তিল হচ্ছে ক্যালসিয়ামে ও আয়রনের সব থেকে বড় যোগান দাতা। এতে প্রায় ৯৬৯ মিলি গ্রাম ক্যালসিয়াম থাকে। প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষের জন্য প্রতিদিন ৮ মিলিগ্রাম ও মহিলাদের ১৮ মিলিগ্রাম আয়রনের প্রয়োজন হয়। তিলে প্রায় ১০ মিলিগ্রাম আয়রন থাকে। বিনা উদ্ভাবিত বিনাতিল-১ হতে ৫২%, বিনাতিল-২ হতে ৪০%, বিনাতিল-৩ ও বিনাতিল-৪ হতে ৪৩% তেল পাওয়া যায়। বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা (বিনা) কর্তৃক উদ্ভাবিত জাত বিনাতিল-১, বিনাতিল-২, বিনাতিল-৩ ও বিনাতিল-৪ এর গড় ফলন ১.৩-১.৫ মে. টন/হে.।
দেশের সকল এলাকায় তিল চাষ সম্ভব। বেলে দো-আঁশ বা দো-আঁশ মাটি জাতগুলো চাষের জন্য বেশি উপযুক্ত। তাপমাত্রা ২৫-৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামলে বীজ গজাতে দেরি হয় এবং চারাগাছ ঠিকমতো বাড়তে পারে না। তিল জাতগতভাবে খরা সহনশীল তবে জলাবদ্ধতা সহনশীল নয়, বাড়ন্ত অবস্থায় অনবরত বৃষ্টিপাত হলে তিল গাছ মরে যায়। তবে বপনের সময় মাটিতে রসের পরিমাণ কম থাকলে একটি হালকা সেচ দিয়ে জোঁ আসার পর চাষ দিয়ে বীজ বপন করে বীজ গজানোর বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। এর পর ফুল আসার সময় জমিতে রসের অভাব হলে একবার এবং পরবর্তীতে ফল ধরার সময় আবার খরা হলে আরও একবার সেচ দেয়া যেতে পারে। যেহেতু তিল ফসল দীর্ঘ জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। তাই জমির মধ্যে মাঝে মাঝে নালা কেটে বৃষ্টি বা সেচের অতিরিক্ত পানি দ্রুত নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করে ফসলকে রক্ষা করতে হবে এবং উৎপাদন মৌসুমে পানি জমে থাকে না এ রকম জমি তিল চাষের জন্য নির্বাচন করতে হবে। অধিক ফলন পেতে হলে অন্যান্য ফসলের মতো তিলের জমিও আগাছামুক্ত রাখতে হবে। চারা অবস্থায় প্রায় ২০ দিন পর্যন্ত তিল গাছের বৃদ্ধি ধীর গতিতে হতে থাকে, ফলে এ সময় জমির আগাছা দ্রুত বেড়ে তিল গাছ ঢেকে ফেলতে পারে। তাই এ সময় একটি নিড়ানি দিতে হবে। তাছাড়া বীজ বপনের পূর্বেই জমি থেকে ভালোভাবে আগাছা পরিষ্কার করে নিতে হবে। আমরা জানি কৃষি পরিবেশ অঞ্চলভেদে সারের মাত্রা কমবেশি হয়ে থাকে। তাই সাধারণভাবে একরপ্রতি ৪০-৫০ কেজি ইউরিয়া, ৫৫-৬০ কেজি টিএসপি, ১৬-২০ কেজি এমওপি এবং ৪০-৫০ কেজি জিপসাম প্রয়োগ করা যেতে পারে। জমি প্রস্তুতকালে অর্ধেক ইউরিয়া এবং অন্যান্য সকল সার মাটির সঙ্গে ভালোভাবে মিশিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। অবশিষ্ট ইউরিয়া সার বীজ বপনের ২৫-৩০ দিন পর গাছে ফুল আসা পর্যায়ে উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। তেল ফসলের বীজের পুষ্টতার উপর বোরন সারের সরাসরি প্রভাব রয়েছে। এই সারের অভাবে বীজ পুষ্ট হয় না। বর্তমানে বাংলাদেশের কিছু কিছু এলাকায় জিংক ও বোরন সারের ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাই জিংক ও বোরন সারের ঘাটতি এলাকায় একর প্রতি ৪ কেজি জিংক সালফেট ও ৩ কেজি বরিক এসিড প্রয়োগ করতে হবে।
বিনা উদ্ভাবিত বিনাতিল-২ জাতটি আকস্মিক বৃষ্টির ফলে সৃষ্ট সাময়িক জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে। বিনাতিল-২ জাতটি অঙ্গজ বৃদ্ধি পর্যায় ৮ মাত্রার লবণাক্ততা সহনশীল, তবে বিনাতিল-৩ ও বিনাতিল-৪ জাত দু’টি। ৬ ডেসিমেন/মিটার পর্যন্ত লবণক্ততা সহনশীল। বিনাতিল-২ জাতটির বীজাবরণ কালো তবে বিনাতিল-৩ ও বিনাতিল-৪ জাতের বীজাবরণ ধূসর কালো। শাখাবিহীন বিনাতিল-১ এর প্রতি পত্রকক্ষে ৪-৫টি ফল থাকে এবং ফলগুলো আকারে লম¦াটে। বিনা উদ্ভাবিত অন্য জাতগুলোর মধ্যে বিনাতিল-২ ও বিনাতিল-৩ এর প্রতি পত্রকক্ষে ২-৪টি ফল এবং বিনাতিল-৪ এর প্রতি পত্রকক্ষে ৩-৫টি ফল থাকে। জীবনকাল বিবেচনায় বিনাতিল-৩ একটি আগাম তিলের জাত। জাতটির জীবনকাল ৮০-৮৫ দিন। তবে পরিপক্ব অবস্থায় কৃষি পরিবেশভেদে জমির রসের উপর ভিত্তি করে জীবনকাল ২-৫ দিন বৃদ্ধি পায়। শাখাবিহীন বিনাতিল-১ এর জীবনকাল-৮৫-৯০ দিন। ২-৪টি প্রাথমিক শাখাযুক্ত বিনাতিল-২ ও ৩-৫টি প্রাথমিক শাখাযুক্ত বিনাতিল-৪ এর জীবনকাল ৮৭-৯২ দিন। তবে যদি আকস্মিক বৃষ্টিতে সাময়িক জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় তবে জীবনকালের সাথে জলাবদ্ধতার সময়কাল যোগ করতে হবে।
আবাদি জমির পরিমাণ বৃদ্ধি না করে শুধুমাত্র উন্নত জাত ব্যবহার করে একই পরিমান জমি হতে ০.৩৫৮ লক্ষ টন অতিরিক্ত তিল উৎপাদন সম্ভব। বিনা’র চলমান গবেষণা হতে দেখা যায় পানি সাশ্রয়ী তিল শস্য বিন্যাসে অন্তর্ভুক্তির (আমন-গম-তিল) মাধ্যমে বরেন্দ্র অঞ্চলে ৬৮% বেশি লাভ করা সম্ভব। তাছাড়া আমন-মসুর-তিল শস্য বিন্যাস প্রচলনের মাধ্যমে নড়াইল, ফরিদপুর, কৃষ্টিয়া এলাকায় ৪৫% বেশি লাভ করা সম্ভব। শস্য বিন্যাসে তিলের অন্তর্ভুক্তি জমির উর্বরতা নিশ্চিত করে। তিলের শিকড় মাটির অনেক গভীরে প্রবেশ করতে সক্ষম। এটি জমির পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি জমির বুনট ও গঠনের ভারসাম্য রক্ষা করে। তাছাড়া শস্যবিন্যাসে তিলের অন্তর্ভুক্তি ফসলের নেমাটোডিয়াল রোগের বংশবিস্তার নিয়ন্ত্রণ করে। আমাদের দেশের অধিকাংশ চর এলাকা খরিফ মৌসুমে প্রয়োজনীয় সেচের অভাবে পতিত থাকে।আবার কিছু চর এলাকার পানি সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর মাসে নামতে শুরু করে। খরিফ-১ মৌসুমের মতো বিনা উদ্ভাবিত তিলের জাতসমূহ রবি মৌসুমেও চাষ করা যায়। তাই চর এলাকায় বর্ষার পানি নেমে গেল সাথে সাথে তিল বপন করা সম্ভব। মুগসহ অন্যান্য ফসলের সাথে সাথী ফসল হিসেবেও তিলের আবাদ করা সম্ভব, তবে সাথী ফসল হিসেবে চাষ করলে প্রধান ফসলের জন্য জমি প্রস্তুত করতে হবে। ছিটিয়ে বপনের ক্ষেত্রে হেক্টর প্রতি ৭.৫-৮ কেজি এবং সারিতে বপন করার জন্য ৬-৭ কেজি বীজ প্রয়োজন। তবে সাথী ফসল হিসেবে আবাদ করার সময় উভয় ফসল কি হারে বা কত সারি পর পর কোন ফসলের বীজ বপন করা হবে, তার উপর নির্ভর করে বীজের হার নির্ধারণ করতে হবে। প্রতি বছর ৫% করে অতিরিক্ত জমি তিল চাষের আওতায় আনা সম্ভব হলে ২০৩০ সালের মধ্যে আর ০.৫৪ লক্ষ হেক্টর জমি তিল চাষের আওতায় আনা সম্ভব, যা হতে অতিরিক্ত ০.৭৫ লক্ষ টন তিল পাওয়া সম্ভব। খরা ও লবণাক্ততা সহিষ্ণু বিনা উদ্ভাবিত তিলের জাতসমূহের যথাযথ সম্প্রসারণের মাধ্যমে দেশের চর এলাকা ও উপকূলীয় এলাকার ৬-৮ লবণাক্ত জমি তিল চাষের আওতায় আনা সম্ভব। তেল ছাড়া সরাসরি তিলের ব্যবহার ও বহুল পরিচিত। গরম ভাতের সাথে তিলের ভর্তা একটি মুখরোচক খাবার। তাছাড়া কুষ্টিয়া এলাকার তিলের খাজা দেশ বিখ্যাত। একই সাথে কনফেকশনারিতে বিস্কুট, পাউরুটি, রোল, কেকে, কুকিজ ও ক্যান্ডি তৈরিতেও তিল ব্যবহৃত হয়। বিনাতিল-১ এর খোসা পাতলা ও রং সাদা হওয়ায় এটি সরাসরি ব্যবহার করা যায়, অন্যদিকে বিনার অন্য জাতগুলোর খোসা ছাড়িয়ে ব্যবহার করা যায়। দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য এটি অল্প পরিসরে বসতবাড়ির আঙিনায় কিংবা বেগুন ও অন্যান সবজি ফসলের সীমানায় লাগোনো যায়। খোসা থেকে তিল ছাড়ানোসহ তিলের খাজা, নাড়ু ইত্যাদি কাজ সরাসরি মহিলাদের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়ে থাকে। এতে করে বাড়তি কর্মসংস্থানসহ কৃষিতে নারীর অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত হচ্ছে।
দেশে করোনাভাইরাসজনিত রোগের প্রাদুর্ভাবের সময় খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিত করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ৩১ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন। এর একটি হচ্ছে ‘খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা চালু রাখতে হবে। অধিক ফসল উৎপাদন করতে হবে। কোন জমি যেন পতিত না থাকে। পরিশেষে বলা যায় যে, দেশের আমদানি নির্ভরতা কাটিয়ে দেশকে তৈল ফসলে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার ক্ষেত্রে বিনা উদ্ভাবিত তিল ফসলের উচ্চফলনশীল জাতের ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
লেখক : ১পরিচালক (গবেষণা), বিনা ময়মনসিংহ-২২০২, ২ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগ, বিনা ময়মনসিংহ-২২০২, যোগাযোগের জন্য : মোবাইল : ০১৭১৭১৮০৩৯৫, ইমেইল :saikat.ag88@gmail.com